পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২ জুন, ২০১২

একুশ শতক: ভূমিব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর

মোস্তাফা জব্বার
॥ এক ॥
খবরটি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার। গত ২৯ মে এই পত্রিকাটিতে খবর প্রকাশিত হয় যে, সমন্বয়হীনতার কারণে ভূমিসংক্রান্ত নথি ডিজিটাইজেশন প্রকল্পের কাজে ধীরগতি নিয়ে অসন্তোষপ্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। 
আমি যদি সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারি, তবে অর্থমন্ত্রীর এই অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। বরাবরই তিনি অপ্রিয় কথা বলে ফেলেন এবং সেজন্য মাঝে মধ্যে সমালোচনার মুখোমুখিও হন। তবে বাস্তবতা হলো যে, সত্যকে সত্য বলার সাহস তিনি এখনও হারিয়ে ফেলেননি। খবরটির শিরোনাম থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, সভায় তিনি কি পরিমাণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঘটনাচক্রে এই খবরটি যে সভায় জন্ম হয়েছে সেই সভায় আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম এবং পুরো বিষয়টিই আমার জানা। এর আগেও এই বিষয়ে যে কয়টি সভা হয়েছে তাতেও আমি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ক্ষোভের কথা শুনেছি। তবুও দৈনিক সংবাদ থেকেই খবরটি তুলে ধরছি।
“গত ২৮ মে সচিবালয়ে এ সংক্রান্ত এক পর্যালোচনা সভা শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান যে ভূমিসংক্রান্ত কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এর অন্যতম কারণ সমন্বয়হীনতা। ভূমি মন্ত্রণালয়, জরিপ অধিদফতর এবং নিবন্ধন পরিদফতরের মধ্যে কাজের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। এ কারণে অনেক দিন আগে কাজটি শুরু হলেও তেমন কোন সুফল পাওয়া যায়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি সংক্রান্ত নথি ডিজিটাইজেশন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ও সচিব মোখলেছুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, ভূমি ডিজিটাইজেশন প্রকল্পে গতি আনতে এবং সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমি সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী দুই মাসের মধ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে বলে অর্থমন্ত্রী জানান।
অর্থমন্ত্রী জানান, সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি অগ্রগতি না হওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হলে এক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দও কোন সমস্যা হবে না। ভূমি নিবন্ধন কার্যক্রমের জটিলতার কথা তুলে মন্ত্রী বলেন, ভূমি নিবন্ধন পদ্ধতি সহজ করা হবে। এক অফিসে সব কাজ (ওয়ান স্টপ সার্ভিস) করা যাবে। এতে সব তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হবে। নিবন্ধন গ্রহণকারী ব্যক্তি মূল দলিল পাবে। কম্পিউটারে রক্ষিত নথি থেকে ছাপিয়ে (প্রিন্ট করে) তথ্য সরবরাহ করা গেলেও তার কোন পরিবর্তন করা যাবে না। মুহিত আরও জানান, ভূমি ডিজিটাইজেশন কাজের জন্য নেওয়া পাইলট প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করেছে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি তথ্য কেন্দ্র স্থাপনে তাদের পরামর্শ রয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় না হলেও দুই উপজেলা মিলে অন্তত একটি তথ্যকেন্দ্র করার ব্যাপারে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভূমি ডিজিটাইজেশন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাবরেজিস্ট্রারদের বাধা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, ৩টি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাইজেশন প্রকল্প চলছে। সেখানে তারা বুঝতে পেরেছে বাধা দিলেও এ প্রকল্প ঠেকানো যাবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার তিন বছর পর অর্থমন্ত্রী এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও আসলে অবস্থাটি মোটেই আশাবাদের নয়।
কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশ সোগান দিয়ে তিন বছরেরও বেশি শাসনকাল পার করার পর এখন সাধারণ মানুষের মাঝে প্রতিদিনই প্রশ্ন জাগছে এই সোগানটির বিপরীতে আগামী সময়গুলোতে সাধারণ মানুষ কি সুফল পাবে। এ কথা বলা যাবে না যে, সাড়ে তিন বছরের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর তেমন কিছু বাস্তবায়ন হয়নি। অবশ্যই অনেক কাজ হয়েছে। এক নাগাড়ে অনেক ছোট ছোট কাজের কথা বলা যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। প্রচুর সভা-সেমিনার এমনকি মেলা হয়েছে। মেলা হচ্ছেও। ২০১২ সালে প্রতিটি জেলায় ডিজিটাল বাংলাদেশকে উপস্থাপনা করার জন্য ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরে। মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিং এখন অতি সাধারণ বিষয়। নানা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের এটুআই-প্রকল্প পরিচালকের মতে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ বিভাগীয় পর্যায়ের সব সেবা আইসিটি নির্ভর হয়ে যাবে।
তবে খুব বড় মাপের বা চোখ ধাঁধানো কিছু যা গ্রামের মানুষের বা সাধারণ জনগণের জীবনে দৃশ্যমান হয়েছে অথবা মানুষের জীবনকে একদম পাল্টে দিয়েছে তেমন বড় কাজ তেমন একটা দেখা যায় না। আবার অপেক্ষাকৃত বড় মাপের কাজের সব সঠিকভাবে সফল হয়েছে এমনটাও বলা যাবে না। গ্রামে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পত্রিকাগুলোর খবর হচ্ছে, এগুলো যেমনটা চলা উচিত ছিল তেমনটা চলছে না। এমনকি একটি উপজেলার ২৫টির মাঝে ২৩টি তথ্যকেন্দ্রই অচল থাকার খবরও আমরা দেখেছি। তবুও মানুষ সান্ত¡না পেতে পারে যে, এসব তথ্যকেন্দ্র স্থাপিত তো হলো। দিনে দিনে অবস্থার যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটিও সত্য।
আমরা জেনেছি, গ্রামে মোবাইল ব্যাংকিং যাবার কথা। গ্রামের আখচাষীদের ডিজিটাল পুঁজি প্রচলনের কাজটি প্রধানমন্ত্রীই আগে উদ্বোধন করেছেন। জাতীয় তথ্যকোষ নামক একটি ওয়েবসাইটের উদ্বোধন করে বলা হয়েছে যে, এই ওয়েবসাইটটি থেকে সাধারণ মানুষ বা গ্রামের মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পাবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই সেলের প্রকল্প পরিচালক নজরুল ইসলাম খান বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ এ কথা বলেন। এই তথ্যকোষে ৫০ হাজার পৃষ্ঠার তথ্য আছে বলে বলা হয়েছে। দু’বছরে এটি নাকি ৫০ লাখ পৃষ্ঠার তথ্যপঞ্জিতে পরিণত হবে। দেশের ৪৫৯৮টি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র এই তথ্যকোষ থেকে উপকৃত হবেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে মনে করা হয়। পত্রিকার খবর অবশ্য ভিন্ন। বলা হচ্ছে এই তথ্যকোষে প্রয়োজনীয় তথ্য নেই। অনেকেই মনে করেন, তাড়াহুড়ো করে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র এবং ই-তথ্যকোষ উদ্বোধন করে বস্তুত সরকারের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। তদুপরি গ্রামের মানুষ এমন কিছু কি পেয়েছে যাকে সে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলতে পারে আমি এটা পেলাম?
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম উদ্বোধন করেছেন। ২০ হাজার ৫০০ স্কুলের এমন ক্লাসরুম চালু হবে। এটি গ্রামের মানুষের কাছে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের একটি রূপরেখা তুলে ধরবে।
প্রকৃতার্থেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যখন আমরা কথা বলি তখন আমাদের ভাবতে হয় যে, এই শব্দ বা সেøাগান দিয়ে সাধারণ মানুষ-গ্রামের মানুষ, কৃষক-শ্রমিক কিভাবে উপকৃত হবে। তার সামনে প্রকৃতার্থেই কিভাবে উপস্থিত করা হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা? কিভাবে তার ডিজিটাল লাইফস্টাইল গড়ে ওঠবে। তার সনাতনী কৃষিযুগের জীবনধারায় এর মাঝে শিল্পযুগের বা যন্ত্রযুগের কিছু না কিছু প্রভাব পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তার কায়িক শ্রম যন্ত্র দিয়ে স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে অতি ধীরে ধীরে বদলাতে থাকা জীবনে গ্রামের মানুষ তার চারপাশের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচাই বাছাই করে দেখছে যে, নতুন সমাজ বা নতুন দুনিয়াটা তার জন্য কেমন। তার চারপাশে একসময়ে সে বিদ্যুত পেয়েছে। তবে বিদ্যুতের সুখের চাইতে এখন তার বিড়ম্বনাই বেশি। কারণ এই সুখ তাকে কেবল কষ্টই দেয়, সুখের ঠিকানা দেয় না। এটি পাওয়ার চাইতে না পাওয়ার বেদনা অনেক বেশি। সে তার ব্যবহারের জন্য ডিজেল ইঞ্জিন পেয়েছে। সেই ইঞ্জিন সে পানি সেচে ব্যবহার করে, নৌকায় লাগায়, ধান মাড়াই কলে লাগায় বা ভ্যান গাড়ি চালাতে ব্যবহার করে। তার চারপাশে সে বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল পেয়েছে। তার হাতের কাছে সে এক সময়ে রেডিও পেত। এখন সে টিভিও পায়। এসব যন্ত্র সে ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করার আগেই পেয়েছে। এর বাইরে আধুনিক জীবন বলতে তার কাছে পৌঁছেছে মোবাইল ফোন। এটি তার জীবন বদলে দিয়েছে অনেকটা। দিনে দিনে তার মোবাইল ফোন তাকে বেশ কিছু সেবা দিতে শুরু করেছে। এই যন্ত্রটি তার অতি চেনা কথা বলার যন্ত্র। একে সে এখনও আলাদাভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের বিষয় হিসেবে দেখে না। তবে দিনে দিনে এর মাঝে এমন সব সেবা সে পেতে শুরু করেছে যাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে যুক্ত করা যায়। কিন্তু আমরা যদি তাকে সত্যি সত্যি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বাদ দিতে চাই তবে তার অতি প্রয়োজনীয় এবং দৈনন্দিন জীবনের অংশবিশেষকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। ভূমি হলো তার তেমন একটি ক্ষেত্র। সেজন্যই তার ভূমি ব্যবস্থার খোল নলচে পাল্টাতে হবে। 
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে যে, বাংলাদেশের দুর্নীতির সবচেয়ে বড় আখড়াটি হলো ভূমি ব্যবস্থায়। বাংলাদেশে বসবাসকারী কোন মানুষকে এই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত করার জন্য কোন তথ্যপ্রমাণ দিতে হবে না। তাকে কোন পরিসংখ্যান দিয়ে কোন বিষয় প্রমাণ করতে হবে না। কারণ প্রায় প্রতিটি মানুষই জানে যে, এর সঙ্গে কেবল দুর্নীতিই নয়, দেশের মামলা মোকদ্দমার সিংহভাগও জড়িত। সম্ভবত এটিও সত্য যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাটিও হতে যাচ্ছে ভূমিসংক্রান্ত। আমরা জানি জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের ভূমির পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। আমরা কিলোমিটার প্রতি এত বেশি লোক বাস করি যে, এক সময়ে আমাদের সকল মানুষের জন্য শুধু বাসস্থান পাওয়াই দুরূহ হয়ে পড়বে। মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল একটি ভূখ-ে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস সত্যিই অভাবনীয়। তদুপরি প্রতিদিন বাড়তি জনসংখ্যার চাপ নিতে হচ্ছে এই দেশটিকে। দেশের কিছু বিশেষ এলাকা যেমন উপকূল, দ্বীপ, জলাভূমি-নিম্নাঞ্চল, বিল অঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল বা হাওর অঞ্চল; যেখানে মানুষের বসবাস প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি, সেসব অঞ্চল ছাড়া প্রয়োজনীয় বাসস্থান এবং চাষের জমি বলতে গেলে নেই। নগরায়ন বা শিল্পায়ন জমির ওপর আরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। 

ঢাকা, ১ জুন ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com.পড়স, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন