মোস্তাফা জব্বার
॥ তিন ॥
বাংলাদেশের ভূমিব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে সাম্প্রতিককালে কিছুটা নড়াচড়া শুরু হয়। এ বিষয়ে সর্বশেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হয় গত ২৮ মে ২০১২ অর্থ মন্ত্রণালয়ে (কক্ষ নং ৩৩১, ভবন নং ৭)। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় অনেক তথ্য জানা যায়। সেই সভার আশু সিদ্ধান্ত হলো একটি রোডম্যাপ তৈরি করার। দু’মাসের মাঝেÑমানে জুলাই ১২ মাসের মাঝে সেই রোডম্যাপ তৈরি হবার কথা। যদিও সেই সভার পর প্রায় তিন সপ্তাহ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এবং রোডম্যাপ তৈরির বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই তথাপি জুলাই মাস পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি যে কোন না কোনভাবে এর কিছু না কিছু অগ্রগতি হবে। এই সভাটি অনুষ্ঠানের আগে যেসব কার্যক্রম নেয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলো আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি।
গত ১১ আগস্ট ২০১০ বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে (ভবন নং ৪, কক্ষ নং ৩২৬) ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার সভাপতিত্বে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ প্রশাসন ও বেসরকারী উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাচক্রে আমিও সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম এবং সেই সুবাদে ভূমিসংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনা বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থাটি আমার পক্ষে অবহিত হওয়া সম্ভব হয়। সেই সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছিল, “বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর দেশের সকল এলাকায় ডিজিটাল নকশা ও ভূমি মালিকদের রেকর্ড প্রস্তুত, স্যাটেলাইট প্রযুক্তিসহ ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম, ডিজিটাল নকশা ও খতিয়ান প্রণয়ন ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর কর্র্তৃক ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘সাভার ডিজিটাল জরিপ’ ২০০৯-এর কাজ শুরু করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ৪৪টি মৌজায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম মাননীয় ভূমি মন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ভিশনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরে সম্প্রতি ১৯১টি মৌজায় সম্পাদিত জরিপ অনুযায়ী ৪,৪১,৫০৬ (চার লাখ একচল্লিশ হাজার পাঁচশত ছয়)টি খতিয়ান ও ৪,০৮৯ (চার হাজার ঊননব্বই)টি মৌজাম্যাপ শীট ডিজিটাইজেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রস্তুতকৃত রেকর্ড ওয়েবসাইটে শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে। ‘কম্পিউটারাইজেশন অব ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট’ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় ঢাকা জেলার ৫টি উপজেলাকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেয়া হয়েছে। এ কাজে সফলতা পাওয়া গেলে সারাদেশে ৬৪ জেলাকে এর আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সর্বশেষ জরিপে প্রণীত মৌজাম্যাপ ও খতিয়ানের ওপর ভিত্তি করে পার্বত্য তিন জেলা ব্যতীত বাংলাদেশের সব উপজেলা ও সিটি সার্কেলের ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের লক্ষ্যে “ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ প্রকল্প (১ম পর্যায়) প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২,০৫২.৮৪ (দুই হাজার বায়ান্ন দশমিক আট চার কোটি) টাকা। প্রকল্পটিতে অর্থ বিভাগের সম্মতি পাওয়া গিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে শীঘ্রই তা প্রেরণ করা হবে। এ ছাড়া সেটেলমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন করে প্রমাপ অর্জনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ডিজিটাল জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, আন্তর্জাতিক সীমার স্ট্রিপ ম্যাপ ডিজিটাইজেশন ও আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের ডিজিটাল ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণ, ম্যাপ প্রিন্টিং প্রেসের আধুনিকায়ন, সারাদেশে ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন অগ্রগতি, ডিজিটাল ভূমি তথ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ ‘ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রজেক্ট শীর্ষক’ প্রকল্পের আওতায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সহায়তায় ১২.৯৭ মিলিয়ন ডলার ঋণের আশ্বাস পাওয়া গেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার সব মৌজার সর্বশেষ জরিপে প্রণীত মৌজাম্যাপ ও খতিয়ান এবং মিউটেশন খতিয়ানকে ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা হবে।”
কার্যপত্রটি পাঠ করার পর বুকটা ফুলে যাবার মতো দশা হয়েছিল। সভায় মাননীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মহাপরিচালক ও অন্যরা যেভাবে এই ডিজিটাল রূপান্তরটি দুয়েক বছরের মাঝেই সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তাতে আমি সত্যি সত্যি খুশি হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যদি কোনভাবে অতীতের দিকে নজর যায় তবে তার মাঝে হতাশা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। অতীতেও এমন অনেক পাইলট প্রকল্প সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে যার মৃত্যু হয়েছে সেখানেই। খতিয়ান ও মৌজা মুদ্রণ কাজটির সূচনা হয়েছে দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে-কিন্তু সফলতা একেবারেই নেই। তবুও যদি এডিবির টাকায় এত বড় কাজটি শুরু হতে পারেÑএতে আমাদের আশায় বুক বাঁধার উপায় থাকবে।
সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভূমি রেকর্ড ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. আসলাম আলমের উপস্থাপনা। তিনি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনায় অনেক বাস্তব প্রেক্ষিত আলোচিত হয়েছে।
আমি এখানে বিষয়গুলোকে খুব সংক্ষেপে আবার উল্লেখ করছি। প্রথমে আইনের কথা বলা যায়। আমাদের দেশের উত্তরাধিকারী আইন ও ভূমি সংক্রান্ত অন্যান্য আইন কার্যত ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের। ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বড় লক্ষ্য হতে হবে ভূমি সংস্কার এবং এর ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার। প্রথমত এজন্য ভূমিসংক্রান্ত আইনগুলোকে আমূল বদলাতে হবে। এর মাঝে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি মীমাংসা করতে হবে সেটি হচ্ছে মালিকানা। কেউ একটি জমি কিনল এবং সেই কেনা জমি অন্য একজন দখল করে রাখলে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ হবে- সেটির মীমাংসা হতে হবে। জমির নিবন্ধন মানেই মালিকানা-নাকি দখল মানেই মালিকানা সেটি যেমন জরুরী, তেমনি কার উত্তরাধিকার কে কার কাছে বিক্রি করল বা কে ভোগ দখল করল এসব প্রশ্নের মীমাংসার জন্যও আইনের সুনিদির্ষ্টি নির্দেশনা থাকা দরকার। আবার কে খাজনা দিল, কার নামে দলিল, উত্তরাধিকারসূত্রে কে জমিটা বিক্রি করতে পারে বা কে পেতে পারে না ইত্যাদি ছাড়াও আছে জমির অতীত অনুসন্ধান ও মালিকানা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা। এক নাম্বার খতিয়ান বা খাস জমিবিষয়ক জটিলতা ও অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক জটিলতারও অবসান হওয়া চাই। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে পৃথক আদালত করে ভূমি সংক্রান্ত মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে হবে। সাম্প্রতিককালে একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। এখন কেবল দলিল হলেই সেটি নিবন্ধিত হয় না। ভূমির বিগত ২০ বছরের মালিকানার বিবরণ দলিলে কেবল থাকলেই হয় না, কাগজপত্রও দাখিল করতে হয়। আমরা সচিবালয়ে এসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে শুনছি কিন্তু বাস্তবে এর অবস্থা কি সেটি এখনও জানি না। দলিল নিবন্ধন করার সময় কে কতটা জাল তথ্য কিভাবে দিতে পারেন সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখে সংশোধনের ব্যবস্থা দরকার।
ভূমি নিবন্ধনের আরেকটি কাজের কথা শুনছি। সেটি হচ্ছে মূল দলিল হস্তান্তর নিয়ে। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে তারা মূল দলিলের স্ক্যান করা কপিকে প্রিন্ট করে বালাম বই বানাতে শুরু করবেন এবং মূল দলিলটি তারা তাৎক্ষণিকভাবেই ফেরৎ দিতে পারবেন। ২৮ মে’র সভাতে সেই তথ্যটি প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে আমি মনে করি, ভূমিব্যবস্থাপনাকে এনালগ বা কাগজভিত্তিক রেখে আইন বদলালেও তার প্রকৃত সুফল জনগণ পাবে না। এজন্য ভূমির তথ্যাদি বিদ্যমান এনালগ কাগুজে পদ্ধতিকে ডিজিটাল করতে হবে। ভূমি সংক্রান্ত সকল ধরনের নকশা ডিজিটাল করতে হবে। জমি রেজিষ্ট্রি, হস্তান্তর, রেকর্ড, মামলা-মোকদ্দমা, আইনী ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে হবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগৃহীত চিত্রকে ভিত্তি করে, জিও রেফারেন্স সংযুক্ত করে ডিজিটাল নকশা তৈরি করে এর সাথে জমির মালিকানা এবং অন্যান্য তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে। এইসব তথ্য সাধারণ মানুষ যাতে খুব সহজেই পেতে পারে তার জন্য এগুলো ইন্টারনেটে পাবার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার যে, কেবল ইন্টারনেটে তথ্য রাখলেই দেশের সাধারণ মানুষ সেইসব তথ্য নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে তেমনটি ভাবার কোন কারণ দেখিনা। বরং আমি মনে করি যে, ইন্টারনেটে তথ্য রাখার পাশাপাশি গ্রামের মানুষের হাতের কাছে ভূমিবিষয়ক ডিজিটাল তথ্য অবশ্যই পৌঁছাতে হবে।
এই ডিজিটাল ব্যবস্থাটি এমন হবে যে, মানুষ যেমন করে টেলিফোন বিল বাড়িতে বসে জানতে পারে, ব্যাংকের ব্যালেন্স যেমন করে জানতে পারে. একটি স্টার তারপর তিন/চারটি সংখ্যা এবং হ্যাস বোতাম চাপে ও পুরো তথ্যটি তার কাছে চলে আসে, তেমনি মানুষ এটিও জানতে পারবে যে, কোন জমিটি কার মালিকানায় আছে, এর খাজনা কত, কবে এর শেষ খাজনা দেয়া হয়েছে এবং এটি কার দখলে আছে। একই সঙ্গে মানুষ এটিও জানতে পারবে যে, জমিটি কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক দেয়া আছে কিনা বা এর মালিকানা নিয়ে কোন আদালতে কোন মামলা আছে কিনা ইত্যাদি। মালিকানার বদল বা অন্য কোন রেকর্ডের পরিবর্তনও সঙ্গে সঙ্গে আপডেট করতে হবে। ফলে ভূমি নিয়ে জালিয়াতি-প্রতারণা করার কোন সুযোগ থাকবে না। ভূমি রেকর্ডের সাথে ডিজিটাল ভোটার তালিকা এবং ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পকে যুক্ত করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি জানা যাবে যে, কোন ব্যক্তির কোথায় জমি আছে এবং কোন সম্পদের মালিক কে। প্রতিটি মানুষেরই একটি সম্পদের বিবরণী থাকতে হবে। দেশের (প্রয়োজনে বিদেশেরও) যেখানেই তার যেসব সম্পদ থাকবে তার বিবরণ ঐ হিসাবে থাকবে। কেউ সেই সম্পদ বিক্রি করলে সেটি তার হিসাব থেকে বাদ যাবে। আবার কেউ কোন সম্পদ কিনলে তার হিসাবে সেই সম্পদ যোগ হবে। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক হিসাব থেকে শুরু করে আয়কর পর্যন্ত সবকিছুই একটি বোতামের নিচে নিয়ে আসা যাবে।
ঢাকা, ১৫ জুন ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস- আবাস’র চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ॥
ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net
॥ তিন ॥
বাংলাদেশের ভূমিব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে সাম্প্রতিককালে কিছুটা নড়াচড়া শুরু হয়। এ বিষয়ে সর্বশেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হয় গত ২৮ মে ২০১২ অর্থ মন্ত্রণালয়ে (কক্ষ নং ৩৩১, ভবন নং ৭)। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় অনেক তথ্য জানা যায়। সেই সভার আশু সিদ্ধান্ত হলো একটি রোডম্যাপ তৈরি করার। দু’মাসের মাঝেÑমানে জুলাই ১২ মাসের মাঝে সেই রোডম্যাপ তৈরি হবার কথা। যদিও সেই সভার পর প্রায় তিন সপ্তাহ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এবং রোডম্যাপ তৈরির বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই তথাপি জুলাই মাস পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি যে কোন না কোনভাবে এর কিছু না কিছু অগ্রগতি হবে। এই সভাটি অনুষ্ঠানের আগে যেসব কার্যক্রম নেয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলো আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি।
গত ১১ আগস্ট ২০১০ বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে (ভবন নং ৪, কক্ষ নং ৩২৬) ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার সভাপতিত্বে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ প্রশাসন ও বেসরকারী উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাচক্রে আমিও সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম এবং সেই সুবাদে ভূমিসংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনা বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থাটি আমার পক্ষে অবহিত হওয়া সম্ভব হয়। সেই সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছিল, “বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় বাস্তবায়নে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর দেশের সকল এলাকায় ডিজিটাল নকশা ও ভূমি মালিকদের রেকর্ড প্রস্তুত, স্যাটেলাইট প্রযুক্তিসহ ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম, ডিজিটাল নকশা ও খতিয়ান প্রণয়ন ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর কর্র্তৃক ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘সাভার ডিজিটাল জরিপ’ ২০০৯-এর কাজ শুরু করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ৪৪টি মৌজায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম মাননীয় ভূমি মন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ভিশনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরে সম্প্রতি ১৯১টি মৌজায় সম্পাদিত জরিপ অনুযায়ী ৪,৪১,৫০৬ (চার লাখ একচল্লিশ হাজার পাঁচশত ছয়)টি খতিয়ান ও ৪,০৮৯ (চার হাজার ঊননব্বই)টি মৌজাম্যাপ শীট ডিজিটাইজেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রস্তুতকৃত রেকর্ড ওয়েবসাইটে শীঘ্রই উদ্বোধন করা হবে। ‘কম্পিউটারাইজেশন অব ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট’ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় ঢাকা জেলার ৫টি উপজেলাকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেয়া হয়েছে। এ কাজে সফলতা পাওয়া গেলে সারাদেশে ৬৪ জেলাকে এর আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সর্বশেষ জরিপে প্রণীত মৌজাম্যাপ ও খতিয়ানের ওপর ভিত্তি করে পার্বত্য তিন জেলা ব্যতীত বাংলাদেশের সব উপজেলা ও সিটি সার্কেলের ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের লক্ষ্যে “ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ প্রকল্প (১ম পর্যায়) প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২,০৫২.৮৪ (দুই হাজার বায়ান্ন দশমিক আট চার কোটি) টাকা। প্রকল্পটিতে অর্থ বিভাগের সম্মতি পাওয়া গিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে শীঘ্রই তা প্রেরণ করা হবে। এ ছাড়া সেটেলমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসের সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন করে প্রমাপ অর্জনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ডিজিটাল জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, আন্তর্জাতিক সীমার স্ট্রিপ ম্যাপ ডিজিটাইজেশন ও আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের ডিজিটাল ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণ, ম্যাপ প্রিন্টিং প্রেসের আধুনিকায়ন, সারাদেশে ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন অগ্রগতি, ডিজিটাল ভূমি তথ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ ‘ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রজেক্ট শীর্ষক’ প্রকল্পের আওতায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সহায়তায় ১২.৯৭ মিলিয়ন ডলার ঋণের আশ্বাস পাওয়া গেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার সব মৌজার সর্বশেষ জরিপে প্রণীত মৌজাম্যাপ ও খতিয়ান এবং মিউটেশন খতিয়ানকে ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা হবে।”
কার্যপত্রটি পাঠ করার পর বুকটা ফুলে যাবার মতো দশা হয়েছিল। সভায় মাননীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মহাপরিচালক ও অন্যরা যেভাবে এই ডিজিটাল রূপান্তরটি দুয়েক বছরের মাঝেই সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তাতে আমি সত্যি সত্যি খুশি হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যদি কোনভাবে অতীতের দিকে নজর যায় তবে তার মাঝে হতাশা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। অতীতেও এমন অনেক পাইলট প্রকল্প সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে যার মৃত্যু হয়েছে সেখানেই। খতিয়ান ও মৌজা মুদ্রণ কাজটির সূচনা হয়েছে দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে-কিন্তু সফলতা একেবারেই নেই। তবুও যদি এডিবির টাকায় এত বড় কাজটি শুরু হতে পারেÑএতে আমাদের আশায় বুক বাঁধার উপায় থাকবে।
সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভূমি রেকর্ড ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. আসলাম আলমের উপস্থাপনা। তিনি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থার কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। তার আলোচনায় অনেক বাস্তব প্রেক্ষিত আলোচিত হয়েছে।
আমি এখানে বিষয়গুলোকে খুব সংক্ষেপে আবার উল্লেখ করছি। প্রথমে আইনের কথা বলা যায়। আমাদের দেশের উত্তরাধিকারী আইন ও ভূমি সংক্রান্ত অন্যান্য আইন কার্যত ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের। ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বড় লক্ষ্য হতে হবে ভূমি সংস্কার এবং এর ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার। প্রথমত এজন্য ভূমিসংক্রান্ত আইনগুলোকে আমূল বদলাতে হবে। এর মাঝে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি মীমাংসা করতে হবে সেটি হচ্ছে মালিকানা। কেউ একটি জমি কিনল এবং সেই কেনা জমি অন্য একজন দখল করে রাখলে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ হবে- সেটির মীমাংসা হতে হবে। জমির নিবন্ধন মানেই মালিকানা-নাকি দখল মানেই মালিকানা সেটি যেমন জরুরী, তেমনি কার উত্তরাধিকার কে কার কাছে বিক্রি করল বা কে ভোগ দখল করল এসব প্রশ্নের মীমাংসার জন্যও আইনের সুনিদির্ষ্টি নির্দেশনা থাকা দরকার। আবার কে খাজনা দিল, কার নামে দলিল, উত্তরাধিকারসূত্রে কে জমিটা বিক্রি করতে পারে বা কে পেতে পারে না ইত্যাদি ছাড়াও আছে জমির অতীত অনুসন্ধান ও মালিকানা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা। এক নাম্বার খতিয়ান বা খাস জমিবিষয়ক জটিলতা ও অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক জটিলতারও অবসান হওয়া চাই। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে পৃথক আদালত করে ভূমি সংক্রান্ত মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে হবে। সাম্প্রতিককালে একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। এখন কেবল দলিল হলেই সেটি নিবন্ধিত হয় না। ভূমির বিগত ২০ বছরের মালিকানার বিবরণ দলিলে কেবল থাকলেই হয় না, কাগজপত্রও দাখিল করতে হয়। আমরা সচিবালয়ে এসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে শুনছি কিন্তু বাস্তবে এর অবস্থা কি সেটি এখনও জানি না। দলিল নিবন্ধন করার সময় কে কতটা জাল তথ্য কিভাবে দিতে পারেন সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখে সংশোধনের ব্যবস্থা দরকার।
ভূমি নিবন্ধনের আরেকটি কাজের কথা শুনছি। সেটি হচ্ছে মূল দলিল হস্তান্তর নিয়ে। সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে তারা মূল দলিলের স্ক্যান করা কপিকে প্রিন্ট করে বালাম বই বানাতে শুরু করবেন এবং মূল দলিলটি তারা তাৎক্ষণিকভাবেই ফেরৎ দিতে পারবেন। ২৮ মে’র সভাতে সেই তথ্যটি প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে আমি মনে করি, ভূমিব্যবস্থাপনাকে এনালগ বা কাগজভিত্তিক রেখে আইন বদলালেও তার প্রকৃত সুফল জনগণ পাবে না। এজন্য ভূমির তথ্যাদি বিদ্যমান এনালগ কাগুজে পদ্ধতিকে ডিজিটাল করতে হবে। ভূমি সংক্রান্ত সকল ধরনের নকশা ডিজিটাল করতে হবে। জমি রেজিষ্ট্রি, হস্তান্তর, রেকর্ড, মামলা-মোকদ্দমা, আইনী ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুই ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে হবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগৃহীত চিত্রকে ভিত্তি করে, জিও রেফারেন্স সংযুক্ত করে ডিজিটাল নকশা তৈরি করে এর সাথে জমির মালিকানা এবং অন্যান্য তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে। এইসব তথ্য সাধারণ মানুষ যাতে খুব সহজেই পেতে পারে তার জন্য এগুলো ইন্টারনেটে পাবার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার যে, কেবল ইন্টারনেটে তথ্য রাখলেই দেশের সাধারণ মানুষ সেইসব তথ্য নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে তেমনটি ভাবার কোন কারণ দেখিনা। বরং আমি মনে করি যে, ইন্টারনেটে তথ্য রাখার পাশাপাশি গ্রামের মানুষের হাতের কাছে ভূমিবিষয়ক ডিজিটাল তথ্য অবশ্যই পৌঁছাতে হবে।
এই ডিজিটাল ব্যবস্থাটি এমন হবে যে, মানুষ যেমন করে টেলিফোন বিল বাড়িতে বসে জানতে পারে, ব্যাংকের ব্যালেন্স যেমন করে জানতে পারে. একটি স্টার তারপর তিন/চারটি সংখ্যা এবং হ্যাস বোতাম চাপে ও পুরো তথ্যটি তার কাছে চলে আসে, তেমনি মানুষ এটিও জানতে পারবে যে, কোন জমিটি কার মালিকানায় আছে, এর খাজনা কত, কবে এর শেষ খাজনা দেয়া হয়েছে এবং এটি কার দখলে আছে। একই সঙ্গে মানুষ এটিও জানতে পারবে যে, জমিটি কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক দেয়া আছে কিনা বা এর মালিকানা নিয়ে কোন আদালতে কোন মামলা আছে কিনা ইত্যাদি। মালিকানার বদল বা অন্য কোন রেকর্ডের পরিবর্তনও সঙ্গে সঙ্গে আপডেট করতে হবে। ফলে ভূমি নিয়ে জালিয়াতি-প্রতারণা করার কোন সুযোগ থাকবে না। ভূমি রেকর্ডের সাথে ডিজিটাল ভোটার তালিকা এবং ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পকে যুক্ত করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি জানা যাবে যে, কোন ব্যক্তির কোথায় জমি আছে এবং কোন সম্পদের মালিক কে। প্রতিটি মানুষেরই একটি সম্পদের বিবরণী থাকতে হবে। দেশের (প্রয়োজনে বিদেশেরও) যেখানেই তার যেসব সম্পদ থাকবে তার বিবরণ ঐ হিসাবে থাকবে। কেউ সেই সম্পদ বিক্রি করলে সেটি তার হিসাব থেকে বাদ যাবে। আবার কেউ কোন সম্পদ কিনলে তার হিসাবে সেই সম্পদ যোগ হবে। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক হিসাব থেকে শুরু করে আয়কর পর্যন্ত সবকিছুই একটি বোতামের নিচে নিয়ে আসা যাবে।
ঢাকা, ১৫ জুন ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস- আবাস’র চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ॥
ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন