পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

ভূমিব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর

মোস্তাফা জব্বার


॥ দুই ॥
গত সপ্তাহে এই কলামে আমরা ভূমি ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। বিষয়টি যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব বহন করে তার একটি প্রমাণ হলো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত তাঁর বাজেট বক্তৃতার একটি বড় অংশজুড়ে ভূমি ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি চলমান উদ্যোগ ও সম্ভাব্য উদ্যোগ; উভয় বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমরা আমাদের প্রেক্ষিতটি পর্যালোচনা করার পর অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্যগুলোর আলোকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ৮ জুলাই ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন ৪৪৪ একর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এই হিসাবে প্রতিঘণ্টায় কমছে ১৮ একর জমি। এভাবে চললে আগামী ২০৫৭ সালে এক ইঞ্চি জমিও থাকবে না চাষাবাদ করার জন্য। পত্রিকার খবরে আরও বলা হয়, ১৯৭৪ সালে মোট আবাদি জমি ছিল মোট জমির ৫৯ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে সেটি কমে ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। তখনকার হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ১ লাখ ৬০ হাজার একর আবাদি জমি কমছে। 
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের কারও মাঝেই এ বিষয়ে কোন উদ্বেগ বা শঙ্কা লক্ষ্য করছি না। কেউ যেন ভাবছেন না, ফসলি জমি না থাকলে আমাদের পরিণতি কি হবে? বড় কষ্ট নিয়ে বলতে হচ্ছে, ফসলের জমি না থাকলে কোটি কোটি মানুষের খিদায় অন্ন আসবে কোন্ উৎস থেকে; কথাটি অনুগ্রহ করে কেউ না কেউ ভাবুন।
এ বিষয়ে সম্ভবত কেউ বিতর্ক করবেন না যে, দিনে দিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণের বসবাস করার জন্য জমি ব্যবহৃত হওয়ায় চাষযোগ্য জমি কমছে। এছাড়াও হাটবাজার, রাস্তাঘাট, বাধ-কালভার্ট-সেতু, কারখানা. পেট্রোল পাম্প এবং অন্যান্য কাজেও প্রচুর ভূমি ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশ বা অন্য কোন আইন কোনভাবেই কার্যকর নয়।
সম্প্রতি ভূমি নিয়ে সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করেছি আড়াইহাজারে। সেনাবাহিনী সেখানে একটি আবাসিক এলাকা স্থাপন করতে গিয়ে প্রচ- প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করার জন্য ত্রিশালের মানুষ প্রথমে প্রতিবাদ করে এবং পরে আড়িয়াল বিলে রক্ত দিয়ে সেখান থেকে সরকারকে পিছু ফিরে আসতে হয়। তবুও বিশেষত ঢাকা থেকে চারদিকে; যেদিকেই যাওয়া যাক না কেন, রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর ভূমি দখল আশঙ্কাজনকভাবে চোখে পড়বে। ভয়ঙ্করভাবে চোখে পড়বে যে তারা যেসব জমি দখল করছে তার সবই ফসলি জমি, পুকুর, বিল বা ডোবা। এর ফলে পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে।
তবে ভূমি নিয়ে বাংলাদেশের বড় সঙ্কট হলো এর ব্যবস্থাপনায়। ব্রিটিশ আমল থেকে বিরাজিত এই ভূমি ব্যবস্থায় কার্যকর; কোন সংস্কার হয়নি। বিগত দিনগুলোতে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন করা হলেও আমূল ভূমি সংস্কার কেউ করেনি। কারও কর্মসূচীতেও ভূমি সংস্কার নেই। কোন রাজনৈতিক দল এই কাজটি করতে চায় না। বড় দলগুলো তো বটেই ছোট, বাম বা প্রগতিশীল দলগুলোও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব প্রদান করে না। তারা হাসিনা-খালেদাকে বদলালেও ভূমির ব্যবস্থাপনা বদলাতে রাজি নন। 
ভূমি সংস্কার নিয়ে তেমন কোন কাজ হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পিও ৯৮-এর আওতায় ভূমির সিলিং ১০০ বিঘা করলেও নানা ফাঁকফোকর দিয়ে জোতদারের জমি জোতদারের কাছেই থেকে গেছে। তারা নামে-বেনামে, এক পরিবারকে নানা পরিবারে বিভাজিত করে এসব জমি কাগজেকলমে হস্তান্তর করে নিজের পরিবারের মাঝেই রেখে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তখনকার প্রেক্ষিতে ১০০ বিঘার সিলিংটাই সঠিক ছিল না। সেটি দশ একর বা ১০০০ শতাংশ হলে কিছু ফল পাওয়া যেত। ফলে বঙ্গবন্ধুর ভূমি সংস্কারের ঘোষণার পরও দেশের মোট চাষযোগ্য ভূমির বৃহদংশ স্বল্পসংখ্যক লোকের (পরিবার বললে ভাল হয়) হাতে পুঞ্জীভূত রয়েছে। এই জনগোষ্ঠী আবার নিজেরা জমির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। তারা শহুরে বা অন্য পেশায় জীবনধারণ করে। কৃষক বা ভূমিহীন বা বর্গাচাষীরা এদের জমি চাষ করে। 
১০০ বিঘার সীমাকে বেশি মনে করে ১৯৮৪ সালে কৃষিজমির সর্বোচ্চ সীমা ৬০ বিঘা করা হয়। কিন্তু তাতেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ জমিগুলো যখন পরিবারের বিভিন্নজনের হাতে ভাগ হয়ে যায় তখন ৬০ বিঘার বাড়তি জমি আর অবশিষ্ট থাকেনি।
বর্তমানে দেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা কোটি কোটি। বাসস্থান নেই কোটি কোটি মানুষের। শহরের বস্তি এলাকার অধিবাসীরা প্রকৃতার্থেই ছিন্নমূল। ভূমি ব্যবস্থাপনার ত্রুটির জন্য সরকারের খাসজমি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে চরম দুর্নীতি। প্রকৃত ভূমিহীনরা খাসজমি পায় না। জোতদাররাই নামে-বেনামে খাসজমি দখল করে থাকে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারী কর্মচারীরাও দুর্নীতির মহাসমুদ্রে বাস করে। জমি রেজিস্ট্রি থেকে জরিপ; সর্বত্রই ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না। কিন্তু এর চাইতে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে ভূমি নিয়ে বিরোধ। দীর্ঘদিন ধরে কায়িকভাবে ভূমির রেকর্ডপত্র রক্ষা, রেজিস্ট্রেশন, নকশা প্রস্তুত ও জালিয়াতি ইত্যাদি করার ফলে ভূিম নিয়ে বিরোধ দিনে দিনে বাড়ছে।
সন্ত্রাস, খুনখারাবি, ঝগড়াবিবাদের বড় উৎসই হলো ভূমিসংক্রান্ত। দেশের সর্বাধিকসংখ্যক মামলা-মোকদ্দমাও ভূমি সংক্রান্ত। জালিয়াতি, প্রতারণা, জবরদখলের সঙ্গেও ভূমি ব্যবস্থাপনা জড়িত। সম্প্রতি ভূমিদস্যুতা নামের নতুন একটি অপরাধ যুক্ত হয়েছে। এক ধরনের লুটেরা ধনিকগোষ্ঠী অস্ত্রের শক্তিতে, টাকার জোরে, প্রতারণায়, চাপে ফেলে, সন্ত্রাস করে সাধারণ মানুষের জমি কেড়ে নিচ্ছে। বিগত খালেদা জিয়ার আমলে সাভারে সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আত্মীয়দের গ্রাম দখল নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। এখনও ঢাকার আশপাশে ডেভেলপার, হাউজিং কোম্পানি এসবের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অসংখ্য অভিযোগ। ভূমিদস্যুরা এখন এত শক্তিশালী যে তারা এমনকি মন্ত্রীকেও ধমক দিতে পারে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পাওে না। সরকারের অনীহা, সরকারী ছত্রছায়া এবং ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির জন্য প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ভূমির প্রকৃত মালিকরা আইনের দ্বারস্থও হতে পারে না।
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা কেবল একটি প্রাচীন বিষয় নয়, এটি একটি জঘন্য ধরনের জটিল বিষয়। যুগ যুগ ধরে এটি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। নতুন নতুন সঙ্কট ও নতুন নতুন জটিলতা এর সঙ্কট যুক্ত হয়েছে। কয়েক বছর আগে ভূমি ব্যবস্থাপনার রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে দলিল লেখার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করা হলেও এর নিবন্ধনে, নাম জারিতে ব্যবস্থাপনায় বা অন্য কোন ক্ষেত্রে অন্য কোন ধরনের পরিবর্তন করা হয়নি। টিআইবির হিসাব অনুসারে এটি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। এর কোথাও শত শত বছরেও পরিবর্তনের কোন ছোঁয়া লাগেনি। দেশের সাধারণ মানুষ ভূমি নিয়ে এত বেশি সমস্যা কবলিত যে, সেখান থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায়ও তাদের জানা নেই। সে জানে না কোন্ পথে সে তার বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারে। জমি বিক্রি করতে সে বিপদে পড়ে। জমি কিনতে গেলে সমস্যা। জমির উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা। জমির বন্দোবস্ত নিলে সমস্যা। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকার যেখানেই জমির সঙ্গে যার সম্পর্ক আছে সেখানেই সমস্যা।
জমি মানেই মামলা। জমি মানেই খুন-জখম, ঝগড়া-বিরোধ। ভূমিসংক্রান্ত মামলা বা বিরোধ বছরের পর বছর সম্প্রসারিত হয়। স্থানীয় সালিশি থেকে সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত সীমাহীনভাবে এর অবাধ বিচরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের মতে, দেশে ভূমিসংক্রান্ত একটি মামলার সাধারণ নিষ্পত্তি হতে ৮ বছর সময় লাগে। এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে ১৪ বছর। (সূত্র দৈনিক আজকের কাগজ ২৭ এপ্রিল, ২০০৭) কোন কোন সময় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভূমি সংক্রান্ত মামলা চলে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এর চাইতেও জঘন্য। আমার পৈত্রিক বাড়ির চার হাত জায়গা নিয়ে একটি বিরোধ আদালতে চল্লিশ বছর চলার পর তার নিষ্পত্তি হয়েছে আদালতের বাইরে। আমার জন্য মহম্মদপুরের আবাসিক এলাকায় সরকারের বরাদ্দ করা একটি প্লট নিয়ে ১৯৮৪ সাল থেকে মামলা চলছে এবং সর্বশেষ অবস্থা অনুসারে আমাকে আরেকটি মামলা সুপ্রীমকোর্টে করতে হবে। আমি তো দূরের কথা, কারও সাধ্য নেই এই কথা বলার যে, সেই মামলা আরও কতদিন চলবে। হাইকোর্ট আমাকে সেই বাড়ির দখল প্রদানের জন্য নির্দেশ দিলেও সেখানে বহাল তবিয়তে বেআইনীভাবে দখলদাররা বসবাস করছে। কিন্তু তাদের সরকারও উচ্ছেদ করছে না। ক’দিন আগে আমার নিজের ৪৫ শতাংশ জমির নামজারি করার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে গেলে তারা কাজটি করার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা দাবি করে। অথচ আমার কাগজপত্রে কোন ত্রুটি নেই। ক’দিনে কাজটি করা হবে তা নির্ভর করবে টাকার পরিমাণের ওপর। আমি আরেকটু বেশি টাকা দিলে কাজটা তাড়াতাড়ি হবে। নইলে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। একটি সফটওয়্যার কোম্পানির মতে, বাংলাদেশে ভূমিসংক্রান্ত জটিলতায় জড়িয়ে আছে প্রায় পনেরো কোটি মানুষ। হতে পারে, একই মানুষ একাধিক মামলা বা বিরোধে জড়িয়ে আছে। কিন্তু সংখ্যাটা এমনই।
এতে বোঝা যায়, ভূমি এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য কি ভয়ঙ্কর সঙ্কট তৈরি করে চলেছে। গত ৬ জুন ২০০৯ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ভূমি ব্যবস্থাকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছেন। ডিজিটাল পদ্ধতি ছাড়া এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। কারণ, ভূমির কাজকর্ম একটি বা দু’টি অফিসে সম্পন্ন হয় না। এমনকি একটি মন্ত্রণালয়েও ভূমির কাজকর্ম সীমাবদ্ধ নয়। তিনটি মন্ত্রণালয় এবং অনেক দফতরে ভূমির কাজ হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ভূমির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সরকারের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ভূমিসংক্রান্ত একেক কাজ একেকজন করে থাকে। এদের অবস্থা দ্বীপের মতো। কারও সঙ্গে কারও তেমন কোন সংযোগ নেই। সরকারের যেসব অংশগুলো ভূমি নিয়ে কাজ ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর, ভূমি আপীল বোর্ড, ভূমি সংস্কার বোর্ড, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আঞ্চলিক সেটেলমেন্ট অফিস, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, উপজেলা ভূমি অফিস, উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিস, সাবরেজিস্ট্রার অফিস ও ইউনিয়ন ল্যান্ড অফিস।
তবে এসব অফিস প্রধানত তিন ধরনের কাজ করে থাকে। একটি হলো ভূমির দলিল নিবন্ধন করা। এটি করে থাকে সাবরেজিস্ট্রার অফিস যা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে ভূমির রেকর্ড। এটির জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় রয়েছে। এই দু’টি কাজের বাইরে ভূমির মালিকানা বিষয়টি দেখে থাকে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন আবার ভূমি অধিগ্রহণের কাজও করে থাকে।

ঢাকা, ৯ জুন ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিসÑ আবাস’র চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন