পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

একুশ শতক:ইন্টারনেট ও বাংলা ভাষা

জাতি হিসেবে আমরা যে মাতৃভাষার অনুরক্ত সেটি নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। দুনিয়াজোড়া প্রযুক্তির সহায়তার জন্য রোমান হরফে মাতৃভাষা লেখা এবং ধর্মের নামে আরবী হরফে মাতৃভাষা লেখা এসব প্রবল হুজুগের মাঝেও আমরা কেবল ভাষা আন্দোলন করিনি, বরং এখনও বাংলা আমাদের সকলের প্রিয় ভাষা। যেখানেই সুযোগ পাই সেখানেই আমরা এই ভাষাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করি। সেদিন ইন্টারনেটে এক তরুণীর একটি প্রতিক্রিয়ায় সেটি খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুক ব্যবহার করছেন। ওখানে স্ট্যাটাস লিখছেন বাংলা ভাষায়। কিন্তু ইন্টারনেটে বাংলা হরফে লিখতে পারছিলেন না বলে তিনি রোমান হরফে বাংলা লিখছিলেন। ইদানীং এমনটি হয়েই থাকে। অনেকেই জানেন না যে, কম্পিউটারের বাংলা সফটওয়্যারটিতেই ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সুযোগ রয়েছে। এজন্য একটি বাড়তি কমান্ড ব্যবহার করতে হয়। তবে আমি যখন মোবাইলে কোন এসএমএস পাঠাই তখন তো আমার আর কোন বিকল্প থাকে না। আমাকে রোমান হরফেই বাংলা লিখতে হয়। মোবাইলে বাংলা এসএমএস তৈরি করাটা একটি কঠিনতম কাজ। বিশেষ করে মাত্র ১২টি বোতাম দিয়ে বাংলা লেখা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। শুধু তাই নয়, প্রায় সকল মোবাইলেই বাংলা সমর্থন পাওয়া যায় না বা বাংলা লেখার সুযোগ নেই। 
আমি অবশ্য কম্পিউটারে বাংলা লিখি। আমার মতো অনেকেই যারা জানেন যে, কম্পিউটার দিয়ে ইন্টারনেটে বাংলা লেখা যায় তারা সকল পর্যায়েই বাংলা লেখেন। বস্তুত যাদের কাছে কোন বাংলা সফটওয়্যার নেই তারা ঠিকানা থেকে বিজয় ইন্টারনেট নামক একটি সফটওয়্যার বিনামূল্যে ডাউনলোড করে নিতে পারেন। সেটি ইন্সটল করে নিয়ে পঃৎষ+ধষঃ+া টাইপ করে বাংলা এবং একইভাবে পঃৎষ+ধষঃ+া টাইপ করে ইংরেজী লিখতে পারেন। এজন্য কোন ফন্ট বাছাই করার দরকার নেই। আবার যাদের বিজয় বায়ান্ন, বিজয় একুশে বা বিজয় একাত্তর আছে তাদের এই সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করারও দরকার নেই। সেই সফটওয়্যার দিয়েই পঃৎষ+ধষঃ+া টাইপ করে বাংলা এবং একইভাবে পঃৎষ+ধষঃ+া টাইপ করে ইংরেজী লিখতে পারেন। কিন্তু মোবাইলে সেই সহজ সুযোগটি নেই।
আমি কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারি কারণ কম্পিউটারে ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সফটওয়্যার আমার আছে। যে তরুণীটির কথা বলছি তার কম্পিউটারে বাংলা সফটওয়্যার থাকলেও তিনি জানতেন না যে, সেটি দিয়েই ইন্টারনেটে তিনি বাংলা লিখতে পারেন। সেজন্য তিনিও রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লিখে আসছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি জেনে গেলেন যে, কম্পিউটারে যদি তিনি কন্ট্রোল অলটার বি এর বদলে ভি টাইপ করেন তাহলেই ইন্টারনেটে বাংলা লেখা যায়। তিনি সেটি চেষ্টা করে সফল হলেন। এরপর তিনি কর্ণধার বানানটি লিখতে পারছিলেন না। তখন তাকে জানানো হলো যে, এজন্য প্রথমে র, এরপর জি ও তারপর রেফ যেখানে হবে সেই বর্ণটি লিখতে হবে। তিনি সেটি সফলতার সঙ্গে প্রয়োগও করলেন। এরপর তার ফেসবুকের পেজের মন্তব্য হচ্ছে, “এই আনন্দ আমি ধরে রাখতে পারছি না। ইন্টারনেটে আমি বাংলা লিখতে পারছি সে যে কি আনন্দ! আমি এখন যাকেই পাচ্ছি তাকেই কেবল ইন্টারনেটে কেমন করে বাংলা লিখতে হয় তাই শেখাচ্ছি এবং যাকে শেখাচ্ছি সেও দেখছি চরম আগ্রহের সঙ্গে সেটি শিখছে।” বস্তুত এটিই হলো আমরা বাংলাদেশের ভাষাপ্রিয় মানুষের অনুভূতি।
বিগত তিন বছরে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহাকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। যেখানে ২০০৮ সালে জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৩ ভাগ মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত ছিল ২০১২ সালের মে মাসে সেই সংখ্যা শতকরা ১৮ ভাগে উন্নীত হয়েছে। অঙ্কের হিসাবে সেটি তিন কোটির ওপরে। একই সময়ে মোবাইলের ব্যবহারকারী জনসংখ্যার শতকরা ২৫ থেকে ৫৩ ভাগে উন্নীত হয়েছে। সেটি প্রায় ৯ কোটি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের প্রতিনিধিকে এসব তথ্য দিয়েছে আমাদের টিএ্যান্ডটি মন্ত্রণালয়। এই দুটি উপাত্তের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগটি হলো যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সংখ্যা বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে মোবাইল সংযোগের। জনসংখ্যার শতকরা ১৮ ভাগ যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার শতকরা ৯০ ভাগই মোবাইলের সহায়তায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে। 
বাংলা ভাষী এমন বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন কোন কাজে যুক্ত হয় তখন খুব সঙ্গতকারণেই তার প্রধান বিষয় হয় মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করা। কেউ যদি একটু ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেন তবে দেখবেন বাংলাদেশের বাঙালীরা দেশের ভেতরে বা বাইরে নিজের ভাষা ব্যবহার করতে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে। এজন্য তারা মোবাইলে বা ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু প্রযুক্তিগত সঙ্কটের কারণে বিশেষ করে মোবাইল ফোনে বাংলা ব্যবহার পদ্ধতিগত জটিলতার মাঝে আবদ্ধ হয়ে আছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মোবাইল থেকে রোমান হরফে বাংলা লিখতে হয়। আগের চাইতে অবস্থার উন্নতি হবার পরও বিশেষ করে স্মার্ট ফোনে বাংলার ব্যবহার এখনও সহজ নয়। এমনকি স্মার্ট ফোনের অপারেটিং সিস্টেমগুলোতে বাংলাকে সাবলীলভাবে ব্যবহার করা যায় না যেমনটি কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমে করা যায়।
তবে সম্প্রতি মোবাইলে বাংলা ব্যবহারের একটি মাইলফলক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে সরকারী পথে কেউ বাংলা কীপ্যাড মুদ্রণ ব্যতীত কোন সাধারণ মোবাইল সেট আমদানি করতে পারে না। এটি বাংলা রাষ্ট্রভাষা এমন রাষ্ট্রের জন্য একটি যথার্থ সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের মাঝে কেবল একটি ফাঁক রয়ে গেছে। সেটি হলো, মোবাইল কীপ্যাড বাংলায় হলেও স্মার্টফোনে কোন কীবোর্ড প্রমিত না করায় সেখানে বাংলার ব্যবহার স্থবির হয়ে আছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বাংলা কীবোর্ড প্রমিত করেননি। এক সময়ে তারা আমার বিজয় কীবোর্ড নকল করে তথাকথিত বাংলা কীবোর্ড প্রমিত করেছিল। পরে নকলের দায় এড়াতে বলছে যে, কম্পিউটারের কীবোর্ড প্রমিত করার প্রয়োজন নেই। তারা এটি ভাবেনি যে, কম্পিউটারের যে কোয়ার্টি কীবোর্ড আছে সেটির প্রয়োগক্ষেত্র কেবল প্রচলিত কম্পিউটারই নয়, মোবাইল ফোন যার টাচ প্যাড বা কোয়ার্টি কীবোর্ড আছে তাতে কম্পিউটারের কীবোর্ড ব্যবহার করা যায়। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাপোর্ট টু ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের মতের অমিল আছে। তারা ইউএনডিপির কুমন্ত্রণায় একটি বেসরকারী বাংলা সফটওয়্যারের প্রকাশ্য সমর্থন দিচ্ছে। শুনেছি তারা নাকি এটিকে তথাকথিত ইউনিকোড কম্পাটবিলিটির কথা বলে প্রচলন করার চেষ্টা করছে। সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এক সময়ে একটি সার্কুলার জারি করেছিল। পরে সেটি প্রত্যাহার করেছে। তবে জটিলতা যা থাকার তাতো থেকেই গেছে বরং দিনে দিনে সেটি আরও বেড়েছে। এখন স্কুলের শিক্ষকদেরকে এমনসব বাংলা কীবোর্ড শেখানো হচ্ছে যার সঙ্গে সরকারের আইনগত কোন সম্পর্ক নেই। বরাবরের মতো সরকারই হয়ে দাঁড়িয়েছে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে বাংলা ব্যবহারের বিভ্রান্তি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কারিগর। সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই তার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি যে, মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেমগুলোতে খুব সহজে বাংলা ব্যবহার করা বেশ কঠিন। মোবাইলে বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এরই মাঝে আমরা করেছি। মোবাইলের কীপ্যাডের পাশাপাশি আমরা বাংলার প্রমিত এনকোডিং যেটি ইউনিকোডের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটি নির্ধারিত হয়ে গেছে। এই মানটি নির্ধারণের ফলে কম্পিউটারে বাংলার মান নির্ধারণ নিশ্চিত হয়েছে। এখন যদি মোবাইল ফোনেও একই মান প্রয়োগ করা হয় তবে সকল ডিজিটাল ডিভাইসে বাংলার আদান-প্রদান জটিলতাহীন হতে পারে।
সাম্প্রতিককালে সরকার তার সকল বাংলা তথ্য ইউনিকোড এনকোডিং-এ সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। এতে কোন কোন ফন্ট সরকারের প্রমিতকরণকে অনুসরণ করে সেটিও বলা হয়েছে। অবশ্য সরকারী প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত ফন্টগুলোর মাঝে কেবল সুতন্বীওএমজে-ই বাংলাদেশের প্রমিতকরণ মান বিডিএস ১৫২০:২০১১ অনুযায়ী তৈরি করা। বাকি ফন্টগুলো ইউনিকোড সমর্থন করলেও সেইসব ফন্ট বিডিএস ১৫২০:২০১১ সমর্থন করে না। বস্তুত ইউনিকোড ৬.০ এবং বিডিএস ১৫২০:২০১১ এর মাঝে ছোট দুটি পার্থক্য রয়েছে। ইউনিকোড ৬.০ অনুসারে দাঁড়ি এবং ডবল দাঁড়ি হিন্দী এনকোডিং থেকে নিতে হয়। বৃন্দা, সোলায়মান লিপি, নিকস, মুক্ত ইত্যাদি ফন্টে সেই ইউনিকোড ৬.০ মান বহাল রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এনেকোডিং মানে দাঁড়ি ও ডবল দাঁড়ির জন্য দুটি বাংলা মান রাখা হয়নি। ফলে এসব ফন্ট ইউনিকোড ৬.০ সমর্থন করলেও বিডিএস ১৫২০:২০১১ সমর্থন করেনা।
যাহোক এখন দুটি চ্যালেঞ্জ খুব দ্রুত মোকাবেলা করার প্রয়োজন। প্রথমত ইংরেজি কোয়ার্টি কীবোর্ড যেখানে প্রয়োগ করা হয় সেখানে বাংলার প্রমিত মান কোনটি হবে সেই সম্পর্কে খুব স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। শুধু মোবাইলের কীপ্যাড প্রমিত করার ফলেই কীবোর্ডের জটিলতা শেষ হয়ে যায়নি। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিএসটিআই যদি এই কাজটি সম্পন্ন না করে তবে এর জটিলতা জাতিকে বহন করতেই হবে।
অন্যদিকে এটি খুবই জরুরী যে, স্মার্ট ফোনের অপারেটিং সিস্টেম যেমন এন্ড্রয়েড, সিমবিয়ান, উইন্ডোজ মোবাইল, আইও. এস ইত্যাদিতে সিস্টেম লেভেলে বাংলা লেখার সেই ব্যবস্থা করা যেটি এখন আমরা কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম যেমন উইন্ডোজ, ম্যাক ও লিনাক্সে করেছি। সরকারের যেসব সংস্থা খুব দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারঙ্গম তাদেরই উচিত প্রথমে এই কাজগুলো করা এবং তারপর জনগণ কিভাবে বাংলা লিখবে তার পরামর্শ প্রদান করা। সেই কাজটি না করে তারা যদি কোন না কোন বিশেষ সফটওয়্যারকে সার্টিফিকেট দিতে শুরু করে এবং সেই অনুসারেই পৃষ্ঠপোষকতাও করতে থাকে তবে পুরো বিষয়টি আরও জটিলই হবে।
ভাষার জন্য যে জাতি রক্ত দিয়েছে সেই জাতি কোনমতেই সরকারের কোন না কোন অংশের দায়িত্বহীনতা এবং অতি সক্রিয়তার জন্য ডিজিটাল যুগে তার ডিজিটাল ডিভাইসে মাতৃভাষা ব্যবহারে জটিলতায় ভুগতে পারে না। আমরা যখন ইন্টারনেট সভ্যতায় আছি তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে সেই অনুপাতেই তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি সবিনয়ে বলতে পারি যে, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখন সুখনিদ্রায় ব্যস্ত। এর সাথে যুক্ত সরকারের কপিরাইট অফিস সম্পূর্ণ নীরব। অন্যদিকে সরকারের এটুআই প্রকল্প অতি সংবেদনশীলতা দেখিয়ে পরিস্থিতির সমাধান না করে জটিলতাই বাড়াচ্ছে। অনুগ্রহ করে সকলে এক টেবিলে বসে একটি স্থায়ী সমাধান তৈরি করুন এবং আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য তার মাতৃভাষার প্রতি দরদ প্রকাশের পথটাকে কুসুমাস্তীর্ণ করুন।

ঢাকা, ২৬ মে ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচির প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন