মোস্তাফা জব্বার
॥ তিন ॥
সার্বিকভাবে এটি মন্তব্য করা যায় যে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালে আওয়ামী লীগ যে থ্রাস্ট নিয়ে আইসিটির জন্য কাজ করেছিল এর আগে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তেমন কিছু ছিল না এবং বেগম জিয়ার সরকার ২০০১-০৬ সময়কালে সেটি অব্যাহত রাখেনি। রাজনীতির পাকে ফেলে আওয়ামী লীগ সরকার এই খাতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তাকে রিভার্স করা হয়। ফলে সেই সময়ে প্রায় সব কাজই স্থবিরতার মাঝে লটকে যায়। এরপর ফখরুদ্দীন সরকার তার শাসনকালের প্রথম বছরে বেগম জিয়ার মতোই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে অবহেলা করতে থাকেন। হতে পারে যে, তাদের জন্য সেই সময়ে অগ্রাধিকার হিসেবে রাজনীতিই ছিল। তবে ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন সরকার অন্যান্য বিষয়ের মতো আইসিটিকেও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এই সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা সংশোধন করার প্রয়াসটি প্রশংসা করার মতো। যদিও সরকার তার মেয়াদ শেষ করার আগে তার নীতিমালাটি প্রণয়ন সম্পন্ন করতে পারেনি, তবুও তাদের উদ্যোগের ফলেই পরবর্তী সরকার ২০০৯ সালের নীতিমালাটি অতি দ্রুত প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি বিশাল কাজ ছিল ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তখনকার সরকার দেশটিকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করানোর ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক তৈরি করেছিল।
তিন. ডিজিটাল বাংলাদেশ ॥ রূপরেখা : ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে বর্তমান সরকারের একটি অঙ্গীকার যার মর্মার্থ খুব স্পষ্ট; ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা এক বাক্যে বলি, ‘একুশ শতকের সোনার বাংলা।’ কেউ কেউ একে বলেন, ‘সুখী-সমৃদ্ধ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ।’ আমি বলি, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ যা সব প্রকারের বৈষম্যহীন, প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি বাঙালীর উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। এটি বাংলাদেশের সকল মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা। এটি একাত্তরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প। এটি বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ, উন্নত ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্য মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানোর অঙ্গীকার। এটি বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সোপান। এটি একুশ শতকের সোনার বাংলা।’ আমি আমার বইতে এমনটি অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলে আসছি।
৬ ডিসেম্বর ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত করার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা তাতে যুক্ত হয়। ১১ ডিসেম্বরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় সেটি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী ঘোষণা করে। খুব সঙ্গত কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য এটি হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি কর্মসূচী। যদিও একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর প্রত্যাশা বা স্বপ্নটির বিষয়ে তেমন কোন দলির দলটির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি তথাপি স্বপ্নটি হচ্ছে ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারের রূপকল্প ২০২১-এরই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। ২০০৭ সাল থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। তাতে এর রূপরেখা অনেকটাই বর্ণিত হয়েছে। আমি এখানে কেবল কয়েকটি কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করছি।
ক ॥ জনগণের রাষ্ট্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশাটি ছিল বাংলাদেশ একটি জনগণের রাষ্ট্র হবে, যাকে সত্যিকারের প্রজাতন্ত্র বলা হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিই হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। ধর্ম বর্ণ, গোত্র বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কোন কর্মকা- পরিচালিত হবে না। রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রভাষা এবং বাঙালী জাতির জাতিসত্তা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশসহ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে সংবিধানে বর্ণিত সব সুযোগ-সুবিধা সমভাবে প্রদান করবে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করবে।
আমরা স্বপ্ন দেখি, এই সময়ের শেষে পুরো দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কোন মানুষ বসবাস করবে না। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মানুষের সব মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে এবং সমাজে আর্থিক ও অন্য সব প্রকারের বৈষম্য বিলীন হয়ে যাবে এবং সুশাসন নিশ্চিত হবেÑদুর্নীতি বলতে কিছু থাকবে না। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়াদিসহ সব কিছুতেই জনগণের কর্তৃত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে। এটি ধনিক শ্রেণীর একচেটিয়া লুটপাটের ক্ষেত্র হবে না।
খ ॥ ডিজিটাল সরকার : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীন ও সার্বভৌম সংস্থা। এটি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে। আমরা স্বপ্ন দেখি, জাতীয় সংসদই হবে রাষ্ট্রের সব কর্মকা-ের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিপূর্ণ বিকাশের স্বার্থে সংসদের কার্যক্রমসহ সব রাজনৈতিক কর্মকা- ডিজিটাল হবে। নির্ধারিত সময়ের নির্বাচনে ডিজিটাল পদ্ধতির পরিপূর্ণ ব্যবহারসহ নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্থায় জনগণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে তার মতামত জানাতে পারবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে পারবে ও নির্বাচনের বাইরেও জনমতের প্রতিফলন ঘটানো যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসন সম্পর্কে আমাদের স্বপ্ন হলো; ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকার হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও ডিজিটাল। সেটি হবে দক্ষ ও জনগণের সেবক। সরকারের সকল তথ্য নাগরিকেরা যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারবে। বিচার হোক আর সরকারের কাছে কোন আবেদন করা হোক বা আবেদনের ফলাফল জানা হোক, কোন তথ্য পাওয়া হোক বা দেওয়া হোক, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ডিজিটাল যন্ত্রে ডিজিটাল উপায়ে নাগরিকেরা সরকারের কাছে পৌঁছতে পারবে। কাউকে সশরীরে সরকারী অফিসে আসতে হবে না। সরকার যাবে জনগণের কাছে। ফাইলে বন্দী থাকবে না কোন তথ্য। সরকারের সব তথ্য থাকবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিত করা। স্থানীয় সরকারসহ সরকারের সর্বস্তরের সব নাগরিক সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দক্ষতার সঙ্গে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো হবে। সরকারের কাজ করার পদ্ধতিতে কোন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকবে না এবং কোন স্তরে কোন প্রকারের দুর্নীতি থাকবে না। দেশের প্রশাসন, শিক্ষা, ভূমিব্যবস্থা, ভূমি নিবন্ধন, যাতায়াত, যোগাযোগ ও পরিবহন, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদিসহ সব কর্মকা- ডিজিটাল হবে।
গ ॥ ডিজিটাল জীবনধারা : দেশের সংসদ, সরকার ও জীবনযাপনের সব ব্যবস্থা ডিজিটাল হবার ফলে দেশের মানুষ একটি ডিজিটাল জীবনধারায় বসবাস করবে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিকতা, রাজনীতি, জীবনযাপনসহ সামগ্রিক জীবনধারা ডিজিটাল পদ্ধতির হবে।
ঘ ॥ সার্বজনীন সংযুক্তি : পুরো দেশটির প্রতি ইঞ্চি মাটি যে কোন ধরনের তার বা বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগে যুক্ত থাকবে। বিশ্বের সব দেশের সব প্রান্তের সঙ্গে বিরাজ করবে সেই সংযুক্তি। এই সংযুক্তিতে যুক্ত থাকা দেশের সব নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য হবে। এই অধিকার থেকে কোন নাগরিককে বঞ্চিত করা যাবে না।
চার ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ ॥ অগ্রগতি : ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা প্রদান করে সরকার এরই মাঝে তিনটি বছরের বেশি সময় পার করেছে। খুব সাধারণভাবে হয়ত অনেকের কাছেই এটি দৃশ্যমান হবে না যে, এই সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে আমরা কতটা পথ এগিয়েছি। অনেকেই হয়ত বলবেন, ২০০৮ সালে যে জীবন ছিল জীবন তো এখনও তেমনই মনে হচ্ছে। তবে একটু গভীরভাবে যদি দেখা যায় তবে অনুভব করা যাবে যে, পরিবর্তনটা ব্যাপক এবং এই সামান্য সময়ের মাঝে যতটা পথ আমরা পার হয়েছি সেটি তূলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
এই অগ্রগতির খাতগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখতে চাই।
ক ॥ জনগণের রাষ্ট্র গড়ার পথে : বিগত তিন বছরে দেশটিকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি ছিল দেশের সংবিধানকে তার শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা। এই সময়ে বারবার কাটা-ছেঁড়া করা সংবিধানের সংশোধন, সার্বিক দারিদ্র্য হার কমিয়ে আনা, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক একটি সরকার পরিচালনা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করাসহ নানাভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। গণমাধ্যম, ব্যক্তি ও রাজনৈতিক মহলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশভাবে বজায় রাখার একটি ঐতিহাসিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এই সময়ে। ইভিএম ও ছবিসহ ভোটার তালিকা ব্যবহার করে নির্বাচনকে ডিজিটাল করার সাহসী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এই সময়ে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর পাশাপাশি মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত সেবাসমূহের সম্প্রসারণ করে ডিজিটাল যুগের সূচনা করায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় সমৃদ্ধ হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রায় ৭ শতাংশের কাছাকাছি উন্নীত করা, ৪ লাখ চাকরি প্রদান ও ৬৮ লাখ কর্মসংস্থানসহ নানা পর্যায়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করে নাগরিকদের জীবন মান উন্নয়ন করা হয়েছে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত সোনার বাংলা গড়ে তোলার এই প্রয়াসকে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল সময় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা এটুকু প্রত্যাশা করি যে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২১ সালে আমরা সত্যি সত্যি একটি স্বপ্নের বাংলাদেশে বসবাস করব।
ঢাকা, ০৪ মে ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচির প্রণেতা ॥ mustafajabbar@gmail.com, www.bijoyekushe.net
সার্বিকভাবে এটি মন্তব্য করা যায় যে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালে আওয়ামী লীগ যে থ্রাস্ট নিয়ে আইসিটির জন্য কাজ করেছিল এর আগে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তেমন কিছু ছিল না এবং বেগম জিয়ার সরকার ২০০১-০৬ সময়কালে সেটি অব্যাহত রাখেনি। রাজনীতির পাকে ফেলে আওয়ামী লীগ সরকার এই খাতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তাকে রিভার্স করা হয়। ফলে সেই সময়ে প্রায় সব কাজই স্থবিরতার মাঝে লটকে যায়। এরপর ফখরুদ্দীন সরকার তার শাসনকালের প্রথম বছরে বেগম জিয়ার মতোই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে অবহেলা করতে থাকেন। হতে পারে যে, তাদের জন্য সেই সময়ে অগ্রাধিকার হিসেবে রাজনীতিই ছিল। তবে ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন সরকার অন্যান্য বিষয়ের মতো আইসিটিকেও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এই সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা সংশোধন করার প্রয়াসটি প্রশংসা করার মতো। যদিও সরকার তার মেয়াদ শেষ করার আগে তার নীতিমালাটি প্রণয়ন সম্পন্ন করতে পারেনি, তবুও তাদের উদ্যোগের ফলেই পরবর্তী সরকার ২০০৯ সালের নীতিমালাটি অতি দ্রুত প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি বিশাল কাজ ছিল ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তখনকার সরকার দেশটিকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করানোর ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক তৈরি করেছিল।
তিন. ডিজিটাল বাংলাদেশ ॥ রূপরেখা : ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে বর্তমান সরকারের একটি অঙ্গীকার যার মর্মার্থ খুব স্পষ্ট; ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা এক বাক্যে বলি, ‘একুশ শতকের সোনার বাংলা।’ কেউ কেউ একে বলেন, ‘সুখী-সমৃদ্ধ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ।’ আমি বলি, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ যা সব প্রকারের বৈষম্যহীন, প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি বাঙালীর উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। এটি বাংলাদেশের সকল মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা। এটি একাত্তরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প। এটি বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ, উন্নত ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্য মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানোর অঙ্গীকার। এটি বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সোপান। এটি একুশ শতকের সোনার বাংলা।’ আমি আমার বইতে এমনটি অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলে আসছি।
৬ ডিসেম্বর ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত করার সময় ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা তাতে যুক্ত হয়। ১১ ডিসেম্বরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় সেটি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী ঘোষণা করে। খুব সঙ্গত কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য এটি হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি কর্মসূচী। যদিও একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর প্রত্যাশা বা স্বপ্নটির বিষয়ে তেমন কোন দলির দলটির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি তথাপি স্বপ্নটি হচ্ছে ২০০৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারের রূপকল্প ২০২১-এরই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। ২০০৭ সাল থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। তাতে এর রূপরেখা অনেকটাই বর্ণিত হয়েছে। আমি এখানে কেবল কয়েকটি কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করছি।
ক ॥ জনগণের রাষ্ট্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশাটি ছিল বাংলাদেশ একটি জনগণের রাষ্ট্র হবে, যাকে সত্যিকারের প্রজাতন্ত্র বলা হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিই হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। ধর্ম বর্ণ, গোত্র বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কোন কর্মকা- পরিচালিত হবে না। রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রভাষা এবং বাঙালী জাতির জাতিসত্তা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশসহ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে সংবিধানে বর্ণিত সব সুযোগ-সুবিধা সমভাবে প্রদান করবে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করবে।
আমরা স্বপ্ন দেখি, এই সময়ের শেষে পুরো দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কোন মানুষ বসবাস করবে না। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মানুষের সব মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে এবং সমাজে আর্থিক ও অন্য সব প্রকারের বৈষম্য বিলীন হয়ে যাবে এবং সুশাসন নিশ্চিত হবেÑদুর্নীতি বলতে কিছু থাকবে না। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়াদিসহ সব কিছুতেই জনগণের কর্তৃত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে। এটি ধনিক শ্রেণীর একচেটিয়া লুটপাটের ক্ষেত্র হবে না।
খ ॥ ডিজিটাল সরকার : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বাধীন ও সার্বভৌম সংস্থা। এটি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে। আমরা স্বপ্ন দেখি, জাতীয় সংসদই হবে রাষ্ট্রের সব কর্মকা-ের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিপূর্ণ বিকাশের স্বার্থে সংসদের কার্যক্রমসহ সব রাজনৈতিক কর্মকা- ডিজিটাল হবে। নির্ধারিত সময়ের নির্বাচনে ডিজিটাল পদ্ধতির পরিপূর্ণ ব্যবহারসহ নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্থায় জনগণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে তার মতামত জানাতে পারবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে পারবে ও নির্বাচনের বাইরেও জনমতের প্রতিফলন ঘটানো যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসন সম্পর্কে আমাদের স্বপ্ন হলো; ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকার হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও ডিজিটাল। সেটি হবে দক্ষ ও জনগণের সেবক। সরকারের সকল তথ্য নাগরিকেরা যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারবে। বিচার হোক আর সরকারের কাছে কোন আবেদন করা হোক বা আবেদনের ফলাফল জানা হোক, কোন তথ্য পাওয়া হোক বা দেওয়া হোক, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ডিজিটাল যন্ত্রে ডিজিটাল উপায়ে নাগরিকেরা সরকারের কাছে পৌঁছতে পারবে। কাউকে সশরীরে সরকারী অফিসে আসতে হবে না। সরকার যাবে জনগণের কাছে। ফাইলে বন্দী থাকবে না কোন তথ্য। সরকারের সব তথ্য থাকবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষিত করা। স্থানীয় সরকারসহ সরকারের সর্বস্তরের সব নাগরিক সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দক্ষতার সঙ্গে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো হবে। সরকারের কাজ করার পদ্ধতিতে কোন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকবে না এবং কোন স্তরে কোন প্রকারের দুর্নীতি থাকবে না। দেশের প্রশাসন, শিক্ষা, ভূমিব্যবস্থা, ভূমি নিবন্ধন, যাতায়াত, যোগাযোগ ও পরিবহন, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদিসহ সব কর্মকা- ডিজিটাল হবে।
গ ॥ ডিজিটাল জীবনধারা : দেশের সংসদ, সরকার ও জীবনযাপনের সব ব্যবস্থা ডিজিটাল হবার ফলে দেশের মানুষ একটি ডিজিটাল জীবনধারায় বসবাস করবে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিকতা, রাজনীতি, জীবনযাপনসহ সামগ্রিক জীবনধারা ডিজিটাল পদ্ধতির হবে।
ঘ ॥ সার্বজনীন সংযুক্তি : পুরো দেশটির প্রতি ইঞ্চি মাটি যে কোন ধরনের তার বা বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগে যুক্ত থাকবে। বিশ্বের সব দেশের সব প্রান্তের সঙ্গে বিরাজ করবে সেই সংযুক্তি। এই সংযুক্তিতে যুক্ত থাকা দেশের সব নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য হবে। এই অধিকার থেকে কোন নাগরিককে বঞ্চিত করা যাবে না।
চার ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ ॥ অগ্রগতি : ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা প্রদান করে সরকার এরই মাঝে তিনটি বছরের বেশি সময় পার করেছে। খুব সাধারণভাবে হয়ত অনেকের কাছেই এটি দৃশ্যমান হবে না যে, এই সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে আমরা কতটা পথ এগিয়েছি। অনেকেই হয়ত বলবেন, ২০০৮ সালে যে জীবন ছিল জীবন তো এখনও তেমনই মনে হচ্ছে। তবে একটু গভীরভাবে যদি দেখা যায় তবে অনুভব করা যাবে যে, পরিবর্তনটা ব্যাপক এবং এই সামান্য সময়ের মাঝে যতটা পথ আমরা পার হয়েছি সেটি তূলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
এই অগ্রগতির খাতগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখতে চাই।
ক ॥ জনগণের রাষ্ট্র গড়ার পথে : বিগত তিন বছরে দেশটিকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি ছিল দেশের সংবিধানকে তার শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা। এই সময়ে বারবার কাটা-ছেঁড়া করা সংবিধানের সংশোধন, সার্বিক দারিদ্র্য হার কমিয়ে আনা, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক একটি সরকার পরিচালনা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করাসহ নানাভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। গণমাধ্যম, ব্যক্তি ও রাজনৈতিক মহলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশভাবে বজায় রাখার একটি ঐতিহাসিক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এই সময়ে। ইভিএম ও ছবিসহ ভোটার তালিকা ব্যবহার করে নির্বাচনকে ডিজিটাল করার সাহসী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এই সময়ে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর পাশাপাশি মৌলিক চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত সেবাসমূহের সম্প্রসারণ করে ডিজিটাল যুগের সূচনা করায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় সমৃদ্ধ হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রায় ৭ শতাংশের কাছাকাছি উন্নীত করা, ৪ লাখ চাকরি প্রদান ও ৬৮ লাখ কর্মসংস্থানসহ নানা পর্যায়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করে নাগরিকদের জীবন মান উন্নয়ন করা হয়েছে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত সোনার বাংলা গড়ে তোলার এই প্রয়াসকে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল সময় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা এটুকু প্রত্যাশা করি যে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০২১ সালে আমরা সত্যি সত্যি একটি স্বপ্নের বাংলাদেশে বসবাস করব।
ঢাকা, ০৪ মে ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচির প্রণেতা ॥ mustafajabbar@gmail.com, www.bijoyekushe.net
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন