সরকার ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নামক একটি নতুন বিষয়কে বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করছে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের এই সিদ্ধান্ত মাইল ফলক হিসেবে কাজ করবে। ২৪ বছর ধরে এমন একটি ব্যবস্থার জন্য যে লড়াই করছি, এই সিদ্ধান্ত তার প্রথম বিজয়। দেশকে একটি কম্পিউটার শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে এর কোন বিকল্প নেই। আমি মনে করি, এর পরের বছর সপ্তম ও তার পরের বছর অষ্টম শ্রেণীতে এই বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করার ফলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে কম্পিউটার লিটারেসির হার ব্যাপকভাবে বাড়বে এবং আমরা খুব শীঘ্রই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারবো, এমন একটি কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে পারবো। আমি এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই। তবে এই বিষয়ের পাঠক্রম ও বই নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
ক) ষষ্ঠ-সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠক্রম: ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠক্রমটি কার্যত এই বিষয়ের সূচনা পাঠক্রম হয়েছে। আমি মনে করি শেষাবধি এই পাঠক্রম ১ম থেকে ৫ম শ্রেণীর পাঠক্রম হিসেবে পাঠ্য হবে। খুব সঙ্গত কারণেই ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠক্রমকে আমার কাছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর পাঠক্রম বলে মনে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়টি চালু হলে তার সাথে পাঠক্রমটি সমন্বয় করা দরকার। অর্থাৎ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এই বিষয়টি পাঠ করার পর ষষ্ঠ শ্রেণীতে এসে শিক্ষার্থীরা এর চাইতে অনেক গুণ বেশি শিখতে চাইবে। প্রাথমিকভাবে কম্পিউটার বিষয়টি জানার সূচনা হিসেবে এই পাঠক্রমটি চালু হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়টি চালু হবার সাথে সাথে ষষ্ঠ শ্রেণীর উপযোগী ও প্রাথমিক স্তরের পরবর্তী বিষয়গুলো ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠ্য করতে হবে।
খ) আমার মতে বিষয়টির নাম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি না হয়ে কম্পিউটার শিক্ষা হলেই ভালো হতো। এই বিষয়ের পাঠক্রমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কথা বলা হলেও মূলত এতে কম্পিউটার বিষয়ের দক্ষতাই শেখানো হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনও কম্পিউটার বিষয়ের দক্ষতা অর্জন করানো। এতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে একটি অধ্যায় থাকতে পারে এবং সেটি তত্ত্বীয় হলেই যথেষ্ট। কিন্তু পুরো বিষয়টি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি না হলেই ভালো। কম্পিউটার শেখার শুরুতে এতো বড় একটি ক্যানভাস তুলে না ধরাই শ্রেয়। তাছাড়া বর্তমানে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী পর্যায়ে বিষয়টি কম্পিউটার শিক্ষা নামেই প্রচলিত রয়েছে। বিদ্যমান বিষয়ের সাথে সঙ্গতি থাকাটা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। এই বিষয়টিতে যদি মোবাইল ফোন, রেডিও, টিভি ইত্যাদি বিষয়ের মাঝে দক্ষতা শেখানোর কনটেন্টস পাঠ্য হতো তবেই এর নাম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি হতে পারতো।
সার্বিক বিবেচনায় বিষয়টির নাম কম্পিউটার শিক্ষাই যথাযথ। প্রয়োজনে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিষয়টির নাম প্রাথমিক কম্পিউটার শিক্ষা রাখা যেতে পারে। বিষয়টির নাম তখন এরকম হবে; প্রাথমিক কম্পিউটার শিক্ষা, মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা ও উচ্চ মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা। প্রথমটি প্রথম থেকে অষ্টম ও দ্বিতীয়টি নবম-দশম এবং তৃতীয়টি একাদশ-দ্বাদশ বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য হবে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বইটিকে প্রাথমিক কম্পিউটার শিক্ষা-৬ এবং অন্যগুলোকে শ্রেণীভিত্তিক ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৭ বা ৮ করা যেতে পারে।
পাঠক্রম পার্যালোচনা করে দেখা গেছে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে ওয়ার্ড প্রসেসিং ও অষ্টম শ্রেণীতে স্প্রেডশীট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ৩টি শ্রেণীতেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরিচিতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে কম্পিউটার যন্ত্রপাতি পরিচিতি ও তিনটি শ্রেণীতেই নিরাপদ ও নৈতিক ব্যবহার এবং তিনটি শ্রেণীতেই ইন্টারনেট বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনটি শ্রেণীতে বিষয়বস্তুর পরিবর্তন খুবই কম। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিরক্ত হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদেরকে তিন বছরে নতুন বিষয়বস্তুর সাথে পরিচয় করানো হয়নি।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তিন বছরে শিক্ষার্থীর অতি নগন্য বা অতি প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মদক্ষতা তৈরি হবে মাত্র তিনটি বিষয়ে। যথা ক. ওয়ার্ড প্রসেসিং খ. স্প্রেডশীট ও গ. ইন্টারনেট। পাঠক্রমের বিস্তারিত বিবরণ অংশটুকু দেখে আমার ধারণা হয়েছে যে, গ্রহণ করতে সক্ষম ও অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদেরকে মূলত একই বৃত্তে ৩ বছর ধরে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কতগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয় এই পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতো। পাঠক্রমে সেই কাজটি করা হয় নি।
আমি মনে করি শিক্ষার্থীদেরকে পাওয়ার পয়েন্ট, গ্রাফিক্স, অডিও-ভিডিও, প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা এই তিন বছরে পরিচিত করা যেতে পারে। একই সাথে কম্পিউটারের হার্ডওয়ার সংযোজন করাও পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যাহোক, সূচনা হিসেবে এই পাঠক্রমকে স্বাগত জানিয়েই আগামী ২০১৩ সালের মধ্যেই পাঠক্রমটি পুনরায় পার্যালোচনা করার জন্য অনুরোধ করছি।
খ) ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য বই: আমার কাছে বইটির যে খসড়া উপস্থাপিত হয়েছে তাতে বেশ কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আমার কথা বলার আছে। বিষয়গুলো খুবই গুরুত্ব বহন করে বলে আমি মনে করি।
১) বইটিতে ওয়ার্ড প্রসেসিং শেখানোর জন্য এম এস ওয়ার্ড ও ওপেন অফিস একই সাথে শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি এদেশের কিছু লোক সব সময়েই এমন কিছু কাজ করতে চায় যা তারা নিজেরা শ্রেয় মনে করে। ওরা নিজেরা ওপেন সোর্স ব্যবহার করে না-কিন্তু শিশুদেরকে দিয়ে সেই জটিল কাজটা করাতে চায়। আমরা এটি উপলব্ধি করি যে আমাদের মতো গরিব দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে বাণিজ্যিক সফটওয়্যার কেনা কঠিন কাজ। ওপেন সোর্স এক্ষেত্রে কোন কোন কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। ওয়ার্ড প্রসেসিং-এর কাজে এমন একটি সফটওয়্যার পাওয়া যায় যেটি এমএস অফিস ২০০৩-এর সমতুল্য। কিন্তু এখন ওয়ার্ড প্রসেসর হিসেবে ওয়ার্ড ২০১০ সবচেয়ে জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে ২০০৩ সংস্করণের উপযোগী একটি প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদেরকে শেখানো কোনমতেই উচিত নয়।
বইটিতে বাণিজ্যিক সফটওয়্যার এমএস ওয়ার্ড এবং ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ওপেন অফিস; দুটোই যুক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা একই কাজের জন্য দুটো সফটওয়্যার শিখবে। যারা জীবনে প্রথম কম্পিউটার চর্চা করবে তাদেরকে এমন জটিল অবস্থায় ফেলার কোন মানে নেই। ওপেন সোর্স সফটওয়্যার সম্পর্কে ধারণা দেবার জন্য প্রথমিক স্তরকে বাছাই করা হলেও এই স্তরে একই কাজের জন্য একাধিক এ্যাপ্লিকেশন শেখানো হলে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। তাদেরকে সেই প্রোগ্রাম শেখাতে হবে যেটি তারা কর্মজীবনে ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ যা ব্যবহার করে সেটিই তাদেরকে শেখানো উচিত। এসব জটিলতা বরং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেই ভালো। ২) বইটিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি আছে-কিন্তু এটি কী– তার কোন বিবরণ নেই। এতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা বইটিতে থাকা উচিত। কে, কখন ও কীভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে সেটি এই বইতে না থাকার কোন কারণ নেই। একই সাথে মানবসভ্যতার বিবর্তনে কৃষি ও শিল্পযুগের পর যে ডিজিটাল যুগে আমরা পৌছেছি তার লক্ষ্মণগুলো, বিশেষত ডিজিটাল লাইফ স্টাইল সম্পর্কে ধারণা দিয়ে এটি বলা যায় যে ডিজিটাল বাংলাদেশের হাতিয়ার হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। শিক্ষার্থীরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কেন শিখবে সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই প্রসঙ্গ আলোচনা করা যায়। ৩) বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ কেমন করে হয়েছে তার একটি পরিচিতিও প্রথম অধ্যায়ে থাকা উচিত। আমরা ৬৪ সালে কম্পিউটার আনলাম, ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রচলন করলাম, আমরা মোবাইল ফোন চালু করলাম, ইন্টারনেটকে অনলাইন করলাম, ওয়াইম্যাক্স চালু করলাম; এসব কেন করলাম বা কখন করলাম; সেই বিষয়ে ছোট করে দুয়েকটি অনুচ্ছেদ না থাকার কোন যুক্তি নেই। ৪) মাল্টিমিডিয়া অডিও- ভিডিও এবং ইন্টারএ্যাকটিভিটি বিষয়টি বইতে অনুপস্থিত। আজকাল কম্পিউটার অন করার সাথে সাথে এই যন্ত্রটিকে অডিও-ভিডিও ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ অত্যন্ত ব্যাপক। এ সম্পর্কে ছোট করে ধারণা দেয়া জরুরী। ৫) কম্পিউটারের বিবর্তনের ইতিহাস ও বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা বইটিতে থাকা উচিত। কম্পিউটার কতো প্রকারের ও কী কী সেটি কি একেবারে শুরুতেই বলা উচিত নয়? ৬) বইটিতে র্যাম, মেমোরি কার্ড এসব যন্ত্রকে স্টোরেজ ডিভাইস হিসেবে দেখানো হয় নি। অথচ র্যাম ছাড়া কম্পিউটার চলে না। মেমোরি কার্ডতো সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে নিজের স্টোরেজ ডিভাইস ছাড়াও যে অন্যত্র (যেমন জি মেইল, ফেসবুক ইত্যাদি) তথ্য রাখা যায় তার ধারণা দেয়া উচিত। এটি আসলে ক্লাউড কম্পিউটিং-এর প্রাথমিক ধারণা দেবে। ৭) কম্পিউটারের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফেসবুক- টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের কথা বলা উচিত। ৮) ‘কম্পিউটারের ভাষা ৩ প্রকারের’ ( পৃষ্ঠা- ২১)–এই তথ্যটি বিভ্রান্তিমূলক। এমনকি কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ভাষার কথাও যদি এখানে বলা হয়ে থাকে তবে সেটি এভাবে বলা সঠিক নয়। ৯) এ্যান্টি ভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করার পদ্ধতি শেখানো উচিত। ১০) ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের সফটওয়্যারের একটি বিশাল তালিকার কোন প্রয়োজন নেই। (পৃষ্ঠা-৫০) ওদেরকে এমএস ওয়ার্ড এবং ওপেন অফিস এই দুটি সফটওয়্যারের কথা বললেই হয়। ১১) ওয়ার্ড প্রসেসরের বাংলা সংস্করণ (বাংলায় মেনু-কমান্ড এসব) দেখানোর প্রয়োজন নেই। এটি ইংরেজি হওয়াই বাঞ্চনীয়। ১২) ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ে বাংলা হরফ কেমন করে লিখতে হয় এবং বাংলা কীবোর্ড কেমন করে ব্যবহার করতে হয় বা যুক্তাক্ষর কেমন করে তৈরি করতে হয় সেটি শেখানো উচিত। ১৩) মেইল ব্যবহার করাও শেখানো উচিত। ১৪) বইটিতে অনলাইন চ্যাট ও ভিডিও চ্যাট শেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি আশা করবো যে, পাঠক্রম পর্যালোচনার সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিল্প খাতের সাথে আলোচনা করা হবে এবং ২০১২ সালের পাঠ্যপুস্তকটিকে নতুন করে সাজানো হবে।
মোস্তাফা জব্বার: লেখক, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের প্রবর্তক।